‘জগমগি’—সাহসিকার পূর্ণ আখ্যান
বুদ্ধদেব গুহ শুরু করি ‘মাধুকরী’ দিয়ে। সে আমার জন্য প্রচণ্ড বিদঘুটে সময়। বড়োসড়ো কলেবরের বইটার হাত ধরে বেশিদূর হাঁটা হয়নি। তবু ‘বানজার’ নদীর কথা মনে আছে। মনে আছে—পাহাড়িয়া এক ভারতভূমির অল্পস্বল্প বিবরণে তৃষিতই লাগছিল। একপর্যায়ে কী কারণ অথবা অকারণে যেন খেই হারিয়ে ফেলি।

বুদ্ধদেব গুহ শুরু করি ‘মাধুকরী’ দিয়ে। সে আমার জন্য প্রচণ্ড বিদঘুটে সময়। বড়োসড়ো কলেবরের বইটার হাত ধরে বেশিদূর হাঁটা হয়নি। তবু ‘বানজার’ নদীর কথা মনে আছে। মনে আছে—পাহাড়িয়া এক ভারতভূমির অল্পস্বল্প বিবরণে তৃষিতই লাগছিল। একপর্যায়ে কী কারণ অথবা অকারণে যেন খেই হারিয়ে ফেলি।
বলছিলাম বুদ্ধদেব গুহ’র কথা। তাঁর কথা বলে বেশিদূর আগাতে পারব না আমি, কারণ আক্ষরিক অর্থেই, যখন লেখাটা লিখছি, ‘জগমগি’ দিয়ে তাঁকে শুরু করে, তাঁকে পাঠের অভিজ্ঞতায় সেখানেই আটকে আছি তখনও। এ আলোচনা ‘জগমগি’বিষয়ক।
‘জগমগি’, পূর্ণ ওরফে প্যানা এবং গোপিনাথপড়শি জগমগি’র আখ্যান। প্রেমের আখ্যান। শুরুর দিকটায় কিছু পার্শ্বচরিত্রের সংলাপে সমাজোপভাষাগত একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণার মুখোমুখি হবেন পাঠক।
‘মাগী’ শব্দের অর্থসংকোচনের ব্যবহারিক দিকটির সুন্দর একটা সন্ধান মেলে এখানে। সন্ধানের এদিক-সেদিককার আলোচনা অবশ্য এক্ষেত্রে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক। তাই এড়িয়ে গেলাম।
‘রক্ষিতা’ বিশেষার্থক শব্দটিকে ‘রাখন্তি’ স্থানিক রূপমূল দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। স্পষ্টতই ‘রাখন্তি’ ব্যক্তিবাচক বিশেষ্য। প্রসঙ্গত ‘-ন্তি’ প্রত্যয়ান্ত শব্দে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আমরা ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য গঠন করে করে ডানপিটে শৈশব কাটিয়েছি। ছোটো পিচে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ব্যাটিং পক্ষের সবাই আউট হয়ে গেলে অপরাজিতজন একপ্রান্তে একা খেলবেন কি খেলবেন না, তা স্থির করে দিতাম আমরা এমন বাক্যে—অ্যাক্লা ‘পিডান্তি’ আছে/নাই।
কেবল একটি প্রত্যয়ের ব্যবহার যে ঔপভাষিক বিস্তার এতদূর ঘটাতে পারে, ব্যাপারটা অবাক করা।
আবার ফিরছি গোপিনাথের কাছে। দেখানো হয়েছে উপন্যাসে, গোপিনাথবাবু গোপিনাথপুরে এসেছেন, কোন্ গোপিনাথের নামে স্থাননাম হলো, এটা সেটা। বোঝা যায় তাতে—শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ‘গোপী’ ব্যাপারটি নিয়ে সচেতনভাবেই দৃশ্যকল্প তৈরির প্রবণতা ছিল লেখকের। গোপিনাথ আবার তায় অকৃতদার!
উপন্যাসে গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে পঞ্চাশ দশকের ভারতীয় সমাজের দুটো বিষয়—১. নারীর প্রতি আশ্চর্য এক ঋণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি, ২. শিক্ষাব্যবস্থার চিরাচরিত ত্রুটি। তাতে—
১. জগমগি এরকম একটা সমাজের অংশ হয়ে নিজে ঠান্ডা মাথায় শক্ত থেকেছে নিজের অবস্থানে। সে কারণে তাকে বেশ শক্ত এবং সাহসী চরিত্র বলা যেতে পারে।
আবার,
২. বিষাদের মধ্যে দেখেছি অনেকটা অনিচ্ছায়ই স্রোতে গা ভাসানোর মানস। সেদিক থেকে পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ সবাই যেমন করে, তাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে বিষাদের বিস্তার।
ভারতীয় উপমহাদেশে পতিতাবৃত্তির ইতিহাসে স্মরণীয় নাম গাঙ্গুবাঈ। যতদূর মনে পড়ে, পড়েছিলাম গাঙ্গুবাঈ নায়িকা হবার স্বপ্ন নিয়ে ঘরছাড়া হন যার হাত ধরে, তিনি তাকে বেচে দেন বেশ্যাপল্লীর অন্ধগলিতে। জমিদারী আমলের বাঈজী সংস্কৃতির যোগ এর সঙ্গে রয়েছে, বোঝা যায়। সে যদিও ভিন্ন আলোচনা, সেরকমই হয় কিছুটা, আমাদের জগমগির সাথে। শেষমেশ শারীরিক ভালোবাসার ওপর বিতৃষ্ণ এক মানবধর্মের পূজক হয়ে জাত বিসর্জন দেয় সে। এক কোণঠাসা বাস্তবতার মুখেও অনড় মানবতাবাদের মূর্ত প্রতীক সে।
পুরোপুরি না মিললেও, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চন্দ্রমুখীর ব্যাপারটা বিবেচ্য হতে পারে তুলনায়। সাহসিকতার দিকটা অন্তত।
এদিকে বিষাদ বাংলার শিক্ষক। তার সংলাপে টের পেয়েছি আক্ষেপ ঝরে পড়ছে। শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে সে নিদারুণভাবে চিন্তাক্লিষ্ট। প্রসঙ্গত কিছুদিন আগে এদেশে বানানরীতি নিয়ে অনলাইনে প্রচুর মানুষের পরিহাস লক্ষ্য করেছি।
একজন ভাষাচিন্তক হিসেবে আমার কাছে পরিহাসের ব্যাপারটি ভালো লাগেনি। বিশেষত এবারের সংশোধনে বেশ যৌক্তিক কিছু ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু সেজন্য পড়াশোনার গভীরতা জরুরি। পদ্ধতিগত ত্রুটির দায় দিয়ে দিনের পর দিন আমরা পাঠাভ্যাস স্থগিত রাখতে অভ্যস্ত। উপন্যাসে অবশ্য এ প্রসঙ্গে সরকারনির্বিশেষে কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। সাতষট্টি বছর চলে গেলেও, সীমান্তের এপারে-ওপারে বোধকরি এই বাস্তব সমস্যার কার্যকরী কোনো সমাধান আসেনি। পরম অযত্নে বেড়ে উঠছে আমাদের দুর্বলভিত সন্তানরা।
সাহিত্যে ইতিহাস এবং ভবিষ্যৎ দুই-ই প্রতিফলিত এবং চিত্রায়িত হতে পারে। ‘জগমগি’ নিয়ে আলোচনা হবার জন্য এ দুটো বিষয়ই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
সাহিত্যে ইতিহাস এবং ভবিষ্যৎ দুই-ই প্রতিফলিত এবং চিত্রায়িত হতে পারে। ‘জগমগি’ নিয়ে আলোচনা হবার জন্য এ দুটো বিষয়ই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
জগমগি শেষকালে অনুমিতভাবেই পূর্ণ’র হাত ধরে চলে যায়, ওদিকে ফিরে আসে নাথুদাদার বউ। প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তাই ‘ঝুমু’র ঠিকানা হয় বিষাদ।
মোটাদাগে পরকীয়া এসেছে ‘জগমগি’তে। ‘পরকীয়া’ শব্দটির প্রচলিত অর্থের বাইরের ধারণাটিও বাদ যায়নি বোধকরি। তা সত্ত্বেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বক্তব্য উঠে এসেছে উপন্যাসে। সে কারণেই বুদ্ধদেব গুহ পড়তে মন চায় আবারও।
আমাদের দাদাদের আমলে ইস্ত্রির কাজ সারতে মাথার বালিশের কোনো জুড়ি ছিল না। নিখরচায় নির্ঝঞ্ঝাট একরাতের ইস্ত্রির যজ্ঞে পরে ভাগ বসিয়েছে ধাতব তোরঙ্গের মধ্যে কিছু কাঠকয়লা রেখে কাজ সারার প্রযুক্তি। এসব জেনেছি ফরহাদ খানের বই ‘বাঙালির বিবিধ বিলাস’ পড়ে। ‘জগমগি’র পূর্ণ যখন ইস্ত্রির কাজটা মাথার বালিশে সারতে যেয়ে ভাঁজই এলোমেলো করে ফেলে তখন কপট হাসি পায়।
আমাদের দাদাদের আমলে ইস্ত্রির কাজ সারতে মাথার বালিশের কোনো জুড়ি ছিল না। নিখরচায় নির্ঝঞ্ঝাট একরাতের ইস্ত্রির যজ্ঞে পরে ভাগ বসিয়েছে ধাতব তোরঙ্গের মধ্যে কিছু কাঠকয়লা রেখে কাজ সারার প্রযুক্তি। এসব জেনেছি ফরহাদ খানের বই ‘বাঙালির বিবিধ বিলাস’ পড়ে। ‘জগমগি’র পূর্ণ যখন ইস্ত্রির কাজটা মাথার বালিশে সারতে যেয়ে ভাঁজই এলোমেলো করে ফেলে তখন কপট হাসি পায়।
‘বাঙালির বিবিধ বিলাস’-এ আরো পেয়েছি বাঙালির রেলরোমাঞ্চ এবং রেলরোমান্স—দুই-ই। বুদ্ধদেব গুহ অবশ্য কেবল রোমান্সটাই দেখিয়েছেন—পূর্ণ আর জগমগির।
পূর্ণ’র সততায় আমি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাজারী ঠাকুরকে স্মরণ করেছি। সন্ধ্যের বনজ গন্ধে মনে পড়েছে ‘আরণ্যক’-এর লবটুলিয়া-বইহারের শোভা।
নগ্ন নারীদেহ জল দিয়ে ঢাকার প্রচেষ্টায় যে শিল্পমান, তা যদি আজকের দিনের ফিকশন রাইটাররা বুঝতেন তাহলে রাজ্জাক স্যারের দুঃখ হয়তো কিছুটা লাঘব হতো।
প্রচ্ছদ নিয়ে সাধারণত এ জাতীয় লেখায় আমি লিখি না। এ প্রসঙ্গটি লিখতে হচ্ছে এ লেখায় কারণ, এ প্রচ্ছদটিতে প্রেমে পড়বার এন্তার সাহস জোগানো হয়েছে বলে মনে হয়েছে। এই মেয়েটির কাছাকাছি রকমের আরো বহু ছবি বুদ্ধদেবের অপরাপর বইয়ের প্রচ্ছদে এসেছে কি না ভেবেছি। কূল পাইনি।
Category: Book
Tags:
Share with others
Recent Posts
Recently published articles!
-
Mukto Library Desk
-
Super Admin
-
Nasir Khan
-
Super Admin