এ. জি. স্টকের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি (১৯৪৭ – ১৯৫১)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এ. জি. স্টক।শিক্ষক জীবনের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ লিখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি (১৯৪৭ – ১৯৫১)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন দু’দফায়। প্রথমবার দেশ বিভাগের ঠিক প্রাক-মুহুর্ত থেকে ১৯৫১ সন অবধি, দ্বিতীয়বার বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এ. জি. স্টক।শিক্ষক জীবনের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ লিখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি (১৯৪৭ – ১৯৫১)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন দু’দফায়। প্রথমবার দেশ বিভাগের ঠিক প্রাক-মুহুর্ত থেকে ১৯৫১ সন অবধি, দ্বিতীয়বার বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর।
ইংরেজি বিভাগে শুরু হয় প্রথম পর্বের শিক্ষকতা জীবন। সেই সময়ের স্মৃতিগুলো তিনি তার বইয়ের সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। শুধু মাত্র যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার কথা বলেছেন তা নয়, বইটিতে তিনি সেই সময়ের বাঙালির সামাজিক–সংস্কৃতিক কথা তুলে ধরেন। একজন বিদেশি হয়ে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, সাধারণ জনজীবন, বিকাশমান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির আশা-আকাঙ্ক্ষা, মনস্তাত্ত্বিক গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিশেষ করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব, এ ব্যাপারে তরুণ সমাজের প্রতিক্রিয়া, আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্পর্কের স্বরূপ, সর্বোপরি ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট চাঞ্চল ও গণজাগরণনিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে অগ্নিগর্ভ সে সময়ের যে অন্তরঙ্গ ও বিশদ বিবরণ বর্ণনা দিয়েছেন এই বইয়ে।
এ. জি. স্টক ছিলেন একজন নিবেদিত শিক্ষক।তিনি তাঁর শিক্ষকতা অভিজ্ঞতা ছাড়া তৎকালীন পূর্ব বাংলাকে কিভাবে দেখেছেন এই বই তা উল্লেখ করেন। এমন বস্তুনিষ্ঠ, ঐতিহাসিক মূল্যে লেখা বেশি পাওয়া যায় না।
স্টক তার প্রাচ্যে ক্যারিয়ার বেছে নেওয়ার প্রবন্ধ বর্ণনা করে স্মৃতিকথাটির সূচনা হয়েছিল। অক্সফোর্ড থেকে স্নাতক পাস করার পরে, তিনি সুখে জীবন যাপন করেছিলেন। এ. জি. স্টক আত্মকথায় তিনি খোলামেলা লিখেছেন যে উগান্ডার প্রভাষক পদে তাঁকে ডাকা হয়নি, ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ে ডাক পেলেন তিনি৷ ইংল্যান্ড থেকে সমুদ্রপথে জাহাজে চেপে নানা পথ হয়ে বোম্বে, তারপর ট্রেনে করে কলকাতায় নামলেন তিনি। তিনি বলেছেন, সচেতনভাবেই আকাশপথে না এসে কলকাতা থেকে ঢাকায় এলেন স্টিমারে চেপে। যে জনপদে তিনি শিক্ষাদান করবেন যেন সেখানকার নিসর্গ ও জনজীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ শিক্ষালাভের জন্যই স্টিমারযাত্রা বেছে নিয়েছিলেন স্টক। তিনি বন্দর নারায়ণগঞ্জে নামার রোমাঞ্চকর বিবরণ এভাবে—
‘রাস্তার পাশে অপেক্ষারত একটি সাইকেল-রিকশায় মালপত্র চাপিয়ে যাত্রার শেষ পর্যায় শুরু করলাম। পুরোনো ঢাকা শহর তখন নতুন রাজধানীতে পরিণত হয়েছে। প্রচুর চিৎকার করে ও বেল বাজিয়ে বাজিয়ে রিকশাওয়ালা পা চালাতে লাগল। সরু গলির ভেতর দিয়ে পথচারীর ভিড়ের ভেতর দিয়ে সে চলতে লাগল। পথজুড়ে ছোটাছুটি, কেউ কাউকে খুঁজছে, কেউ কোথাও যাচ্ছে। কেউ দাঁড়াচ্ছে, কারও যেন নিজের ছাড়া অন্যের জন্য ব্যয় করার মতো মুহূর্তটি নেই।’
ঢাকায় এ জি স্টকের সার্বক্ষণিক সহায় ছিল তাঁর বেয়ারা ও বাবুর্চি আবদুল এবং ইংরেজি বিভাগের পিয়ন কালিপদ। আবদুলকে নিয়োগ দিয়েছিলেন উপাচার্যের স্ত্রী—‘বেগম হাসান (উপাচার্য ড. মাহমুদ হাসানের স্ত্রী) আমার জন্য, ইংরেজ-বাড়িতে কাজে অভিজ্ঞ একজন বেয়ারা-বাবুর্চি দেখে রেখেছেন।’
এ জি স্টক তাঁর পূর্ববঙ্গবাসে লব্ধ অভিজ্ঞতার শুরুতেই এখানকার অধিবাসীদের বৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা পান। আবদুল যেন তারই এক প্রতীকপুরুষ—
‘আবদুল হক—আমার বেয়ারা ও বাবুর্চি। সে সত্যিই একটি অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব ছিল। স্বভাবে গুরুগম্ভীর তার পেশায় সেই ছিল শ্রেষ্ঠ, যে কিনা বাছা বাছা ইউরোপিয়ানদের বাড়িতে কাজ করত। সে আমাকে বলেছে যে একসময়ে কলকাতার ইম্পেরিয়াল কেমিক্যালসের ম্যানেজারের বাড়িতে ১৭ জন অধস্তন কর্মচারীর সে ছিল প্রধান পরিচারক। আবার হাইকোর্টের এক কুমার জজের বাড়িতে সে একাই ছিল বাবুর্চি, বেয়ারা, গৃহপরিচারক—সব।…তার সীমিত ইংরেজজ্ঞানে সে আমার চেয়ে বেশি ভালো জেনে ফেলেছে একজন মেমসাহেবের কখন কী কী দরকার আর পা ফেলার আগেই আমি দেখি জিনিসটি তৈরি।’
পুরো বইয়েই আবদুলের নানা কীর্তিগাথা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে৷ এ জি স্টকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-স্মৃতিকথার অনেক ঐতিহাসিক-সামাজিক ও শিক্ষাপ্রাতিষ্ঠানিক মূল্য আছে। কিন্তু তাঁর বেয়ারা কাম বাবুর্চি আবদুলের সঙ্গে ঢাকায় এসে প্রথম ঈদের যে স্মৃতি বর্ণিত হয়েছে, তার মানবিক মূল্য অতুলনীয়।
‘আমি এসে পৌঁছেছিলাম ১ আগস্টে, রোজা শেষের ১০ দিন আগে। এক চান্দ্রমাসব্যাপী এই রমজান, বছর ঘুরে পেছনে যেতে থাকে সৌর-ক্যালেন্ডারকে অনুসরণ করে এবং এর শেষ হয় ঈদ উৎসব দিয়ে, ইসলামি বছরের সবচেয়ে আনন্দের দিন। সেদিন সব বাড়িতে বিশেষ খাবারের আয়োজন করে রোজা ভাঙা হয় অনেকটা ক্রিসমাসের টার্কি বা প্লাম পুডিংয়ের মতো খাবার দিয়ে। সেদিন সবাই নতুন বা সাদা বা পরিষ্কার কাপড় পরে বাইরে আসে, ঝলমল করতে থাকে—পিলগ্রিমস প্রগ্রেসের উজ্জ্বল একজনের মতো; ঈদ মোবারক বলে একজন আরেকজনকে সম্ভাষণ জানায়। তবে নতুন চাঁদ দেখার খবর কেউ না দেওয়া পর্যন্ত কিন্তু উৎসব শুরু হয় না। যদি মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা থাকে, তবে রোজার সময় বেড়ে ৩০ দিন হয়। যদি তার পরও চাঁদ দেখা না যায়, তবে ধরে নেওয়া হয় সে তার নির্দিষ্ট স্থানেই আছে।
‘আবদুল সকালে নাশতার পর ছুটি নিয়ে গেল, অন্তত আমার তো তা–ই মনে হলো। আমি যেহেতু রান্না করা খাবারের চেয়ে আমার সুবিধামতো স্যান্ডউইচ ও কফি দিয়ে দুপুরের খাবার সারতে পছন্দ করতাম, তাই আমার এতে কোনো অসুবিধাই হলো না এবং আমি একটা বই নিয়ে নিরিবিলি সকালটিতে স্থির হয়ে বসলাম কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে আবদুল ফিরে এল, ছোট কন্যাটিকে সঙ্গে নিয়ে, নিজের বাড়িতে তৈরি অপূর্ব একটি খাবারসহ। জাফরানি রং চালের সঙ্গে মাংস ও অপূর্ব মসলা দিয়ে রাঁধা একটি পদ, মিষ্টি, ফল। ওরা দুজনে উদ্ভাসিত হাসি দিয়ে পরিবেশন করছিল, আমি বসে বসে খাচ্ছিলাম। ওরা আমাকে বাদ দিয়ে ঈদের আনন্দের কথা ভাবতেও পারেনি। সব শোভনতা রক্ষা করে ওদের পরিবারেও আমাকে ডাকতে পারছে না, সুতরাং এর চেয়ে ভালো আর কোনোভাবে কাজটি করা যেত না।’ এ জি স্টক ঢাকা ছেড়ে গেছেন ১৯৫১ সালে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধজাত বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার এসেছেন ইংরেজি বিভাগে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে। এ জি স্টক এর Memoirs of Dacca University. বইটি অনুবাদ করেন মোবাশ্বেরা খানম।
Category: Book
Tags:
Share with others
Recent Posts
Recently published articles!
-
Mukto Library Desk
-
Super Admin
-
Nasir Khan
-
Super Admin