ইন্দুবালা ভাতের হোটেল: বেদনার আততিতে এক অসহ্য আনন্দ

ইন্দুবালা এক স্মৃতি কাতরতার নাম। তাঁর স্মৃতিতে সবসময় সবুজ পূর্ব বাংলার খুলনায় কপোতাক্ষ নদ তীরবর্তী কলাপোতা নামের একটা গ্রাম; গ্রামের প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ, আর কাছের মানুষজন। ইন্দুবালা বেদনায় আদ্র কোমল এক স্মৃতির আখ্যান। এই স্মৃতি সারাজীবন বয়ে বেড়ানো মিষ্টি প্রেমের; এই স্মৃতি জীবনের, জীবিকার, একলা মানুষের তুমুল সংগ্রামের। ভাতের হোটেলে তিনি অফুরন্ত বিলিয়ে চলেন তাঁর স্মৃতি রান্নার এক পদ থেকে অন্য পদে।

hero

ইন্দুবালা এক স্মৃতি কাতরতার নাম। তাঁর স্মৃতিতে সবসময় সবুজ পূর্ব বাংলার খুলনায় কপোতাক্ষ নদ তীরবর্তী  কলাপোতা নামের একটা গ্রাম; গ্রামের প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ, আর কাছের মানুষজন। ইন্দুবালা বেদনায় আদ্র কোমল এক স্মৃতির আখ্যান। এই স্মৃতি সারাজীবন বয়ে বেড়ানো মিষ্টি প্রেমের; এই স্মৃতি জীবনের, জীবিকার, একলা মানুষের তুমুল সংগ্রামের।  ভাতের হোটেলে তিনি অফুরন্ত বিলিয়ে চলেন তাঁর স্মৃতি রান্নার এক পদ থেকে অন্য পদে। তাঁর জীবনের গল্প উঠে আসে কুমড়ো ফুলের বড়ায়, বিউলির ডালে, ইলিশের ছ্যাঁচড়ায়, আমের তেলে, মালপোয়ায়, চিংড়ির হলুদ গালা ঝোলে, চন্দ্রপুলি পিঠায়, এবং  কচু বাটায়। কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনের ইন্দুবালা ভাতের হোটেল-ই ইন্দুবালার তীর্থ, জীব প্রেমের মন্দির, একলা হয়ে যাওয়া জীবনের অর্থ। এখানে  ইন্দুবেলার স্মৃতিরা ঘুমের মধ্যে শুনতে পাওয়া শঙ্খ চূড়ের কান্নার মতো যার প্রতিটি আততি বহন করে অসহ্য আনন্দ।

স্মৃতির কোনো সীমানা থাকে না, সীমান্ত থাকে না। দেশ ভাগ হলেও যে সব জায়গায় মানুষ বেড়ে ওঠে, যেখানে মানুষের নাড়ি পোতা থাকে, সেসব জায়গার প্রতি মানুষের ভালোবাসার ভাগ হয় না। সাতচল্লিশের দেশবিভাগ হঠাৎ করে মানুষের ভালোবাসার মাঝে, বন্ধুত্বের ভেতর, স্বজনদের বন্ধনের মধ্যে সীমান্ত তুলে দিয়েছিল;  মানুষের আকুতির ভেতর, মানবিক বন্ধনের ভেতর দেয়াল খাঁড়া করে দিয়েছিল। বন্ধু,স্বজন, প্রিয় জায়গার জন্য মন কেমন করলেও যাওয়া যেত না। কারণ, সীমান্তে  কাঁটাতারের বেড়া। এই বেড়া পার হওয়ার অনেক ঝক্কি। ভারত থেকে বাংলাদেশে কখনো না আসতে পারা ইন্দুবালার মনে হয়, “এক সময়ে যে দেশটা নিজের দেশ ছিল [মানুষ] সেটারই বেড়া টপকায়। প্রত্যেক বছর বৃষ্টি আসে নিয়ম করে দু দেশেই। তবুও সীমান্তের দাগ মুছে যায় না সেই জলে। ” এপারের মেয়ে ইন্দুবালা, ওপারে তাঁর ভেতর জাগিয়ে রাখে এক টুকরো মায়ায় মোড়ানো বাংলাদেশ।

ইন্দুবালা ভাতের হোটেল দুই বাংলার অমোঘ বন্ধনের বয়ান। রাষ্ট্রীয় সীমানা দুই বাংলাকে ছিঁড়ে আলাদা করলেও, কোথাও খুব গভীরে তারা যেন একই। কেননা ইন্দুবালার মতোন অনেকেই তাদের ভেতরে স্মৃতিতে—আবেগে–আত্মীয়তায়–ভালোবাসায় বহন করেন পূর্ববাংলাকে। এই উপন্যাসের অনেকখানি জুড়ে যেমন স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, তেমনি আছে পশ্চিমবঙ্গ বঙ্গের নকশাল আন্দোলনের কথাও।

সবকিছু ছাপিয়ে  মূলত একজন দুর্ভাগ্যপীড়িত নারীর জীবনচরিত বিবৃত হয়েছে এই উপন্যাসে। হেঁশেলের চারদেয়ালে বন্দি একজন নারী নিজেকে রান্নার মধ্য দিয়েই বিস্তৃত করেছেন সারাজীবন। সাধারণ থেকে ক্রমশ হয়ে উঠেছেন অসাধারণ। তিনি বোঝেন ‘জীবনে বিলিয়ে দেওয়ার চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে নেই’। উপলব্ধি করেন, ‘মানুষের ধর্ম হল মোদ্দা কথায় অপর মানুষের সেবা করায়।’ ইন্দুবালা তাঁর নিজ হাতে রান্না করা খাবার দিয়ে তা-ই করেন: ‘জীবে প্রেম।’

কল্লোল লাহিড়ীর গদ্যভাষা সহজ ও সুন্দর।  শব্দের সাবলীল  বুননে তিনি ইন্দুবালার আবেগ, অনুভূতি তুলে ধরেছেন। পড়ে আরাম পাওয়া যায়। উপন্যাসে বর্ণিত জিভে জল আনা  বাঙালি খাবারের মতোই তাঁর গদ্য সুস্বাদু।

Category: Book

Tags:

Share with others