‘তারিণী মাঝি’—বাঁচার আকুতি
‘তারিণী মাঝি’ যেখানে শুরু হয়, সেখানেই, শেষ করবার জন্য প্রয়োজনীয় কৌশলটা অবলম্বন করতে তারাশঙ্কর ভোলেননি। তারিণীকে লম্বাচওড়া বানাতে গিয়ে তিনি আমাদের নিতাইচরণ বীরবংশীর কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন কিছুটা হলেও। আমি শারীরিক বিবরণের কথা বলতে চাচ্ছি।

‘তারিণী মাঝি’ যেখানে শুরু হয়, সেখানেই, শেষ করবার জন্য প্রয়োজনীয় কৌশলটা অবলম্বন করতে তারাশঙ্কর ভোলেননি। তারিণীকে লম্বাচওড়া বানাতে গিয়ে তিনি আমাদের নিতাইচরণ বীরবংশীর কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন কিছুটা হলেও। আমি শারীরিক বিবরণের কথা বলতে চাচ্ছি।
নিম্নবর্গের চরিত্রনির্মাণের ক্ষেত্রে অবিচ্ছেদ্য উপাদান শ্রেণি পার্থক্যের ক্ষেত্রে, তারাশঙ্কর, গল্প লিখতে বসেছেন বলেই হয়তো, ‘তারিণী মাঝি’তে বেশিদূর যাননি। আমরা ‘গণদেবতা’য় তাঁর বিস্তারিত লেখনীশক্তি টের পাই। ‘রাইকমল’ উপন্যাসে যেমন নিম্নবিত্তের ওপর উচ্চবিত্তের স্বভাবজাত অত্যাচারের অল্প একটু নমুনা, তেমনি ‘তারিণী মাঝি’র স্বল্প উপস্থিতির তরুণী সাবিত্রীর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য পর্যন্তই দেখা যায়।
মাঝির চরিত্র হিসেবে তারিণী অসমসাহসী। ময়ূরাক্ষীর খরস্রোতা ধারায় কালাচাঁদকে সাথে নিয়ে ডোঙা চালানো ত বটেই, সাঁতরে ময়ূরাক্ষীকে এফোঁড় ওফোঁড় করাও তার পক্ষে স্বাভাবিক বলেই প্রতীয়মান। এই করতে গিয়েই সে বড়ো ঘরের এক বৌকে ময়ূরাক্ষীর জল থেকে উদ্ধার করলে আমরা অন্য এক তারিণীর পরিচয় পাই।
এই তারিণী মদ্যপ হলেও স্ত্রী-অন্তপ্রাণ। নিজের জন্য মদের পয়সা না নিয়ে স্ত্রীর জন্য নথ নেয়, নিজের জন্য চাদর না নিয়ে স্ত্রীর জন্য শাড়ি নেয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুবের যেমন নিজের শরীরের চিন্তা সরিয়ে রেখে স্ত্রী-সন্তানের খাওয়া-পরা জোটায়, তেমনই খানিকটা। আবার মানিকেরই ‘হলুদ নদী সবুজ বন’-এর ঈশ্বর যেমন। তবে এরা চুরি করে এসব প্রয়োজন মেটালেও তারিণী সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
স্ত্রীটি তার কেমন? স্ত্রীটি তার সুখী। নামেও তা-ই। সুখীকে রাবীন্দ্রিক চরিত্র শর্মিলার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ‘দুই বোন’ উপন্যাসে যে বিভাজন দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ সে বিবেচনায় সুখী মাতৃস্থানীয় নারী। স্বামীর চালচলনে তার ভালোবাসাপ্রসূত খবরদারি বাধার সৃষ্টি করতে চায়।
স্ত্রীটি তার কেমন? স্ত্রীটি তার সুখী। নামেও তা-ই। সুখীকে রাবীন্দ্রিক চরিত্র শর্মিলার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ‘দুই বোন’ উপন্যাসে যে বিভাজন দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ সে বিবেচনায় সুখী মাতৃস্থানীয় নারী। স্বামীর চালচলনে তার ভালোবাসাপ্রসূত খবরদারি বাধার সৃষ্টি করতে চায়।
তারিণী অবশ্য বলে—
মায়ের বুকে ভয় থাকে? বল্, তু বল্, ব’লে যা বলছি। পেটের ভাত ওই ময়ূরাক্ষীর দৌলতে। জবাব দে কথার— অ্যাই!
এ কথার মধ্যে ফুটে ওঠে আশ্চর্য এক বিশ্বাস, আস্থা এবং সাহসের নিদর্শন। এই সাহসটুকুই তারিণীর চরিত্রে আলাদা উচ্চতা দিয়েছে। জন্মগতভাবে সকল মাঝি এমন সাহস রাখে সাধারণত।
সুখীর মধ্যে অন্নপূর্ণার গুণ দেখিয়েছেন তারাশঙ্কর সূক্ষ্মভাবে। দুর্ভিক্ষের সময় যখন সকলে গ্রামত্যাগ করে, তারিণীও জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে খেয়াল করে—সুখীর হাতের শাঁখা ছাড়া আর কোনো গহনা নেই।
এ কথার মধ্যে ফুটে ওঠে আশ্চর্য এক বিশ্বাস, আস্থা এবং সাহসের নিদর্শন। এই সাহসটুকুই তারিণীর চরিত্রে আলাদা উচ্চতা দিয়েছে। জন্মগতভাবে সকল মাঝি এমন সাহস রাখে সাধারণত।
সুখীর মধ্যে অন্নপূর্ণার গুণ দেখিয়েছেন তারাশঙ্কর সূক্ষ্মভাবে। দুর্ভিক্ষের সময় যখন সকলে গ্রামত্যাগ করে, তারিণীও জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে খেয়াল করে—সুখীর হাতের শাঁখা ছাড়া আর কোনো গহনা নেই।
তখন সুখী ম্লান হেসে বলে—
এতদিন চলল কিসে, বল?
এই যে ত্যাগ সুখীর, এখানে এসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাসের অনঙ্গ বৌ এর একই ধরণের ত্যাগের কথা মনে পড়ে। তারিণীদের সংসারে দুর্ভিক্ষের অভাবের তেমন ছায়া দেখা যায়নি এ ত্যাগের আঁচলেই।
অভাবে ত্যাগী নারীচরিত্র শওকত ওসমান তাঁর ‘জননী’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন। নজরুল দেখিয়েছেন ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে।
ঘটনাক্রমে মাঝির বোধশক্তি কাজে লাগিয়ে তারিণী বুঝতে পারে বন্যা আসন্ন। এ ব্যাপারটিকে ডুগডুগির সুরে ধরবার প্রয়াস পেয়েছেন তারাশঙ্কর। ময়ূরাক্ষীসহ রাঢ়বঙ্গের নদীর পাড়গুলোর জীবন ও সংস্কৃতি মাটিঘেঁষা। বাউল সংগীত এদের প্রাণে। ‘রাইকমল’ উপন্যাসে বিস্তারিত জানা যায় এসব।
বন্যার বিবরণে তারাশঙ্করকে দেখি লিখতে—
“ঠিক বন্যার জলের ধারেই সে দাঁড়াইয়া ছিল, আঙুলের ডগায় ছিল জলের সীমা। দেখিতে দেখিতে গোড়ালি পর্যন্ত জলে ডুবিয়া গেল। সে কান পাতিয়া রহিল, কিন্তু বাতাস ও জলের শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যায় না, আর একটা গর্জনের মত গোঁ-গোঁ শব্দ। দেখিতে দেখিতে সর্বাঙ্গ তার পোকায় ছাইয়া গেল। …”
বন্যার বিবরণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ দিয়েছে, দিয়েছে জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’। হুমায়ুন কবিরের ‘নদী ও নারী’তেও বন্যা এসেছে।
পরিস্থিতি যখন আরো খারাপ হয় বন্যার, সুখী বুকপানিতে ডুবলেও তারিণীর তখন কোমরসমান জল। এ অবস্থায় স্ত্রীকে কোমরে জড়িয়ে বাঁচানোর চেষ্টায় রত তারিণীর মধ্যে ধীরে ধীরে আত্মকেন্দ্রিকতা বাসা বাঁধে, আসে অস্তিত্বচেতনা—তাকে বাঁচতে হবে। সুখীও বাঁচতে চায় সর্বশক্তিতে তারিণীকে আঁকড়ে।
পরিস্থিতি যখন আরো খারাপ হয় বন্যার, সুখী বুকপানিতে ডুবলেও তারিণীর তখন কোমরসমান জল। এ অবস্থায় স্ত্রীকে কোমরে জড়িয়ে বাঁচানোর চেষ্টায় রত তারিণীর মধ্যে ধীরে ধীরে আত্মকেন্দ্রিকতা বাসা বাঁধে, আসে অস্তিত্বচেতনা—তাকে বাঁচতে হবে। সুখীও বাঁচতে চায় সর্বশক্তিতে তারিণীকে আঁকড়ে।
শেষমেশ স্ত্রীর গলা টিপে নিজেকে মুক্ত করে নিজের অস্তিত্বচেতনার গল্পটি নিজ হাতেই শেষ করে তারিণী।
এ নিষ্ঠুরতা জীবনতৃষ্ণার অপরপিঠের রূপ। পরাজিত হয় প্রেম, জীবনের আশ্চর্য এ তৃষ্ণার কাছে।
Category: Book
Tags:
Share with others
Recent Posts
Recently published articles!
-
Mukto Library Desk
-
Super Admin
-
Nasir Khan
-
Super Admin