মৈত্রেয়ী–বাংলার রাত ও “ন হন্যতে” : প্রকাশের পিছনের কিছু কথা

‘ন হন্যতে’ ও মৈত্রেয়ী-বাংলার রাত চল্লিশ বছরের ব্যবধানে লেখা দুটি উপন্যাস। ভিন্ন সামাজিক অবস্থানে বেড়ে উঠা দুই জন মানুষের আত্মকথা। সময়ের পরিক্রমায় মির্চা এবং মৈত্রেয়ী দুজনেই বিখ্যাত হয়েছেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে। ১৯৩৩ সালে মির্চা ছিলেন বয়েসে যুবক ও লেখক হিসেবে নতুন। মির্চার লেখায় কাঁচা হাতের ছাপ ও ভগ্ন হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট।

hero

‘ন হন্যতে’ ও মৈত্রেয়ী-বাংলার রাত চল্লিশ বছরের ব্যবধানে লেখা দুটি উপন্যাস। ভিন্ন সামাজিক অবস্থানে বেড়ে উঠা দুই জন মানুষের আত্মকথা। সময়ের পরিক্রমায় মির্চা এবং মৈত্রেয়ী দুজনেই বিখ্যাত হয়েছেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে। ১৯৩৩ সালে মির্চা ছিলেন বয়েসে যুবক ও লেখক হিসেবে নতুন। মির্চার লেখায় কাঁচা হাতের ছাপ ও ভগ্ন হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট।

মৈত্রেয়ী দেবী ১৯৭৪ সালে ‘ন হন্যতে’ লিখছেন। পরিণত বয়সের লেখা। মৈত্রেয়ী দেবীর লেখার হাত দারুণ। রবীন্দ্রসাহিত্যকে কিভাবে জীবনের সঙ্গে মেলাতে হয় তার উদাহরণ রয়েছে বইয়ের পাতায় পাতায়। মৈত্রেয়ী দেবী মমতা ও পরিপূর্ণ জীবন দর্শন দিয়ে তার সম্পর্কটাকে তুলে ধরেছেন । মির্চার মৈত্রেয়ী -বাংলার রাত তুলনামূলক বিচারে অতি সাধারণ মানের বই, প্রেম বঞ্চিত যুবকের হাহাকার, প্রবঞ্চিতের দাহ।  মৈত্রেয়ী দেবী ‘ন হন্যতে’ না লিখলে মির্চার বই সম্ভবতঃ লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে যেত। ১৯৫২ সালের পর বইটির পুনর্মুদ্রণের ইতিহাস নেই। ইংরেজি অনুবাদ ১৯৯৪ সালে।

চার দশকের ব্যবধান মানুষের জীবন ও দর্শনকে অনেক পরিপক্ক করে তোলে। এই পরিপক্কতা মৈত্রেয়ী দেবীর লেখার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। ‘ন হন্যতে’ কে চার পর্বের বই হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে । প্রথম পর্বে বিদগ্ধ ভালোবাসার যন্ত্রণা। দ্বিতীয় পর্বে নিঃসঙ্গ-একাকিত্ব-শান্তির মিলন। তৃতীয় পর্বে কালের উন্মাদনা ও চতুর্থ পর্বে আত্মপলব্ধি, সবটাই এক মোহজালে জীবনকে উপস্থাপনের প্রয়াস।

‘ন হন্যতে’ নিছক সোজা বাংলা ভাষা নয়। তবে ভীষণ কঠিন নয়। লেখার মধ্যে ছন্দের আভা ছড়িয়ে আছে । বেশ কিছু শ্লোক ও কবিতার উল্লেখ আছে লেখার মাঝে মাঝে যা উপন্যাসটিকে আরও অলঙ্কৃত করেছে। সচারাচর শ্লোকের প্রধান উদ্দেশ্য ধর্মালোচনা। ধর্ম মানুষকে মুক্তি দেয়না, বরং আরও আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে। ‘ন হন্যতে’ শ্লোক ব্যবহৃত হয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে। জীবন -প্রেম-ও ভালবাসার ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হয়েছে সংস্কৃত শ্লোক। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে লালিত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের বর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্লোক। শ্লোক হয়ে দাঁড়িয়েছে জ্যোতির্ময়ী প্রেমের আলো, অমোঘ মুক্তির পথ, যা আপাতঃ দৃষ্টিতে ধর্মের গাঁটছাড় থেকে অনেক দূরে ।

‘ন হন্যতে’ নিছক সোজা বাংলা ভাষা নয়। তবে ভীষণ কঠিন নয়। লেখার মধ্যে ছন্দের আভা ছড়িয়ে আছে । বেশ কিছু শ্লোক ও কবিতার উল্লেখ আছে লেখার মাঝে মাঝে যা উপন্যাসটিকে আরও অলঙ্কৃত করেছে। সচারাচর শ্লোকের প্রধান উদ্দেশ্য ধর্মালোচনা। ধর্ম মানুষকে মুক্তি দেয়না, বরং আরও আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে। ‘ন হন্যতে’ শ্লোক ব্যবহৃত হয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে। জীবন -প্রেম-ও ভালবাসার ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হয়েছে সংস্কৃত শ্লোক। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে লালিত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের বর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্লোক। শ্লোক হয়ে দাঁড়িয়েছে জ্যোতির্ময়ী প্রেমের আলো, অমোঘ মুক্তির পথ, যা আপাতঃ দৃষ্টিতে ধর্মের গাঁটছাড় থেকে অনেক দূরে ।

সাহিত্য কর্মের কোনো জাত পাত নেই। কবি সাহিত্যিক যে সমাজে বাস করে কোন না কোন ভাবে সেই সমাজের প্রতিচ্ছবি। মানব ইতিহাসের লিখিত অংশ পুরুষতন্ত্রের জয়গানে ভরপুর। দেশ কাল পাত্রভেদের এই দৃষ্টি ভঙ্গি পুরুষের প্রেম ভালোবাসাকে প্রভাবান্বিত করে আসছে। মাত্র কয়েক দশক ধরে পুরুষতন্ত্রেকে দৃষ্টিভঙ্গি ভাঙার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। মির্চার লেখায় পুরুষতান্ত্রিক প্রভাবকে অস্বীকার করার উপায় নেই। ১৯৯৪ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় এক মলাটে বই দুইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ হবার পর কেউ কেউ মির্চাকে পুরুষ তান্ত্রিক দৃষ্টি ভঙ্গি ও উপনিবেশিক মানসিকতার অভিযুক্ত করেছেন। ভারতীয় সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকার পরেও বইয়ের সমস্ত পাত্র পাত্রীর নাম বদলে দিয়ে শুধু মাত্র মৈত্রেয়ী দেবী ও তার ছোট বোনের প্রকৃত নাম ব্যবহার করা একগুঁয়েমিতার প্রকাশ। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের প্রকাশ। এই একগুঁয়েমি আচরণকে মির্চা নির্বুদ্ধিতা হিসেবে আত্মজীবনীতে বর্ণনা করেছেন। মির্চা কখন ভাবে নাই এই বই কখন ভারতে পঠিত হবে। ত্রিশের কোঠায় আত্মজীবনীমূলক লেখায় যেটা সবচেয়ে ঝামেলার ব্যাপার তা হলো বাহুল্যদোষ।নিজেকে নিজে বিচার করতে গেলে গল্প গোল পাকিয়ে যায়। পড়ন্ত বয়সে, মির্চার নিজের জবানে-

“Not for a single moment did I stop to consider what an indiscretion I was preparing to perpetrate…I changed the names of the characters, of course, except for Maitreyi and her sister Chabu…if it were to have been read by certain persons in Calcutta, the novel would have needed no key to have been deciphered. I never thought, however, about the possibility of its being read in Calcutta…I simply did not ‘visualize’ a public.” ( (Autobiography Volume 1: Journey East, Journey West 1907-1937. Chicago: The University of Chicago Press, 1990, p.239)

পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা মির্চার লেখা ফুটে উঠেছে একথা অস্বীকার করার কঠিন। তবে মির্চার উপনিবেশিক- প্রভুত্ববাদী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন এমন অভিযোগ বিচারমূলক পর্যালোচনার দাবি রাখে। মির্চার আদি নিবাস রোমানিয়া। এই ভাষাতেই মৈত্রেয়ী -উপন্যাস লিখে লেখক হিসেবে পথ চলা শুরু । প্রথম প্রকাশের ১৫ বছর পর ফরাসী ভাষায় মৈত্রেয়ী এর নামান্তর হয় ‘বাংলার রাত’ হিসেবে। ১৯৩০ এর দশকে, মির্চা যখন ভারতে আসেন তখন রোমানিয়া ইউরোপের অন্যতম দরিদ্র দেশ ছিল। সেই সময়কার মির্চার পারিবারিক অর্থনৈতিক বিবরণ খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে বিদেশে পড়তে এসে শিক্ষকের বাড়ীতে থাকার বিষয়টি দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার কথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মির্চার জীবনের নানা বাঁকে মির্চা দেশ থেকে দেশে পাড়ি জমিয়েছেন জীবিকার প্রয়োজন। চাকরি যত উপরের পদেই হোক না কেন গরিব দেশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশে অভিবাসিত হওয়ার যন্ত্রণা অনেক। রোমানিয়া থেকে ফ্রান্স হয়ে আমেরিকায় স্থিতি হওয়া মির্চা উপনিবেশ বিস্তারকারী দেশে জন্ম নেয় নাই। মির্চার বইয়ের ফরাসী অনুবাদ আলোচনায় এসেছে, সেহেতু অনেকেই মির্চাকে ফরাসী ভেবে একহাত দেখিয়ে দিতে পছন্দ করেন। এই ধারাতেই কেউ কেউ মির্চাকে উপনিবেশবাদী -প্রভুত্ব করি হিসেবে দেখে থাকেন।

মৈত্রেয়ী দেবী মির্চার সঙ্গে ১৯৭৩ সালে আমেরিকায় সাক্ষাৎ করেন। এই সময়ের ব্যক্তিগত আলোচনার বিষয় নিয়ে দুইজনের কেউ তেমন কিছু প্রকাশ্যে নিলে যান নি। তবে মির্চার প্রকাশক ও অনুবাদকের সঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবী ব্যক্তিগত চিঠির (১৯৭৪-১৯৮৮) থেকে জানা যায় মৈত্রেয়ী দেবী মির্চাকে বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ মৈত্রেয়ী দেবী জীবনকালে প্রকাশ না করতে রাজি করিয়েছিলেন। ইংরেজি প্রকাশ হলে মৈত্রেয়ী দেবী মামলার হুমকি দিয়েছিলেন।

মৈত্রেয়ী দেবী মির্চার সঙ্গে ১৯৭৩ সালে আমেরিকায় সাক্ষাৎ করেন। এই সময়ের ব্যক্তিগত আলোচনার বিষয় নিয়ে দুইজনের কেউ তেমন কিছু প্রকাশ্যে নিলে যান নি। তবে মির্চার প্রকাশক ও অনুবাদকের সঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবী ব্যক্তিগত চিঠির (১৯৭৪-১৯৮৮) থেকে জানা যায় মৈত্রেয়ী দেবী মির্চাকে বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ মৈত্রেয়ী দেবী জীবনকালে প্রকাশ না করতে রাজি করিয়েছিলেন। ইংরেজি প্রকাশ হলে মৈত্রেয়ী দেবী মামলার হুমকি দিয়েছিলেন।

মির্চার লেখার প্রথম লিখিত প্রতিক্রিয়া ছিল আদিত্য মারিচি নামের কাব্য গ্রন্থ ( নবজাতক প্রকাশনী কলকাতা, ১৯৭২) । এই কবিতার বইটির মুদ্রণ পাওয়া যায়না। এমনকি মৈত্রেয়ী দেবীর প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকায় এই কাব্য গ্রন্থের নাম অনুপস্থিত। মৈত্রেয়ী দেবী গবেষক Ginu Kamani এর আলোচনা থেকে এই বইয়ের নাম , কবিতার বিষয় বস্তু সম্পর্কে জানান যায়। মাত্র ১২টি কবিতা নিয়ে বইটি যে ভাবে নীরবে প্রকাশিত হয়েছিল ঠিক একই ভাবে পাঠকের নজরের বাইরে চলে যায়। মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে মির্চার প্রকাশকের পর চিঠি থেকে জানা যায় “মরিচি” মির্চাকে দেওয়া মৈত্রেয়ী দেবীর স্নেহময় ডাকনাম ছিল। “মরিচি” অর্থ সূর্যের রশ্মি। জৈন ধর্ম মতে মরীচি পুনঃজন্ম নেওয়া ঋষির নাম। Ginu Kamani কবিতাগুলি মৈত্রেয়ী দেবীর যৌবনের পুরানো আবেগের সাথে জড়িত হিসেবে দেখেছেন। ।

১৯৭৪ সালে মৈত্রেয়ী দেবী ‘ন হন্যতে’ লেখেন ও ১৯৭৬ সালে ভারতে এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এই বইয়ে মৈত্রেয়ী দেবীকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। একদিকে মির্চাকে বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ না করতে চাপ প্রয়োগ অপর দিকে ‘ন হন্যতে’ লেখা ও দুই বছরের মধ্যে ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ অনেক প্রশ্নের জন্য দেয়। ১৯৯৪ সালে মির্চার মৃত্যুর পর মৈত্রেয়ী- বাংলার রাত এর ইংরেজি ও পরবর্তীতে বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। মির্চার বইয়ের বাংলা অনুবাদ প্রকাশের পর ‘পাঠকরা ন হন্যতে’ এর বিপরীত ভাষ্য জানতে পারেন। মির্চা ও মৈত্রেয়ী একই ঘটনার দুটি পরস্পর বিরোধী বর্ণনা দিয়েছেন। বাস্তবে একই ঘটনার একটি মাত্র সত্য থাকার কথা। আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বাংলার রাত ও ‘ন হন্যতে’ বর্ণিত পরস্পর বিরোধী দুই বক্তব্যের মাঝামাঝি কোথায় সত্য দাঁড়িয়ে আছে।

Category: Book

Tags:

Share with others