যৎকিঞ্চিৎ বুদ্ধদেব গুহ
২৯ কি তাঁর জীবনের এক নির্ণায়ক সংখ্যা? বুদ্ধদেব গুহের জন্ম ২৯ জুন ১৯৩৬, চলে যাওয়ার দিন ২৯ আগস্ট ২০২১। নির্ণায়ক হোক বা না হোক জোড়-বিজোড়ের মানুষজীবনকেই তো নিজের সারাজীবনের লেখায় সু-বাঙ্ময় করেছেন তিনি।

২৯ কি তাঁর জীবনের এক নির্ণায়ক সংখ্যা? বুদ্ধদেব গুহের জন্ম ২৯ জুন ১৯৩৬, চলে যাওয়ার দিন ২৯ আগস্ট ২০২১। নির্ণায়ক হোক বা না হোক জোড়-বিজোড়ের মানুষজীবনকেই তো নিজের সারাজীবনের লেখায় সু-বাঙ্ময় করেছেন তিনি। পেশায় সফল সিএ, নেশায় আদ্যন্ত লেখক। টপ্পার পারুলবন আর রবীন্দ্রসংগীতের সাগরে প্রিয় পরিব্রাজন ছিল তাঁর। গল্প-উপন্যাসেও এসেছে ফিরে ফিরে গানের কথা। অগীতল প্রাত্যহিকের সঙ্গে লড়াইয়ে মানুষের সুর-সম্বলকে তিনি মূল্য দিতেন। যেমন দিতেন মানুষের মনকে। এতটা গুরুত্ব দিয়ে মনের খুঁটিনাটি চরিত্রের সংলাপে, ঘটনাপ্রবাহে আর বর্ণনাবিন্যাসে তুলে ধরতেন যে বিস্ময় মানতে হতো এই ভেবে-লোকটা নারী ও পুরুষ উভয়ের মনের খোঁজ জানেন কী করে?
‘চাপরাশ’, ‘কোজাগর’, ‘মাধুকরী’, ‘কোয়েলের কাছে’, ‘বাবলি’, ‘সবিনয় নিবেদন’-সহ কত যে গল্প, উপন্যাসে তিনি পাঠকের আপন ঘরের মানুষ হয়ে ওঠেছেন- ভাবলে অবাক হতে হয়। কী করে ভোলা যাবে তাঁর ‘ঋজুদা’ সিরিজ? ঋজুদার সঙ্গে বাস্তবের জঙ্গল থেকে তিনি আমাদের নিয়ে চলেছেন আত্মার বুনো ঘাসলতাপাতাময় অন্তরমহলে। এই তো সম্প্রতি দেখা হল ব্রাত্য বসু পরিচালিত অসামান্য চলচ্চিত্র ‘ডিকশনারি’। এই চলচ্চিত্রের কাঠামো গড়ে ওঠেছে বুদ্ধদেব গুহের ‘বাবা হওয়া’ আর ‘স্বামী হওয়া’ গল্প-সমবায়ে। গল্পগুলো পড়লে অনুধাবন করা যাবে জীবনে ক্রমশ ছুটে চলার মাঝে মধুর ব্রেক কষার কথাই বুদ্ধদেব গুহ তাঁর লেখায় বলতে চান। মেট্রোপলিটন আমাদের মুখ হটিয়ে যে মুখোশ বসিয়ে দেয় তা খুলে বাঁচার মতো বাঁচার বার্তা দেন তিনি।
বুদ্ধদেব গুহ বাংলাদেশে রংপুরে কিছুদিন ছিলেন। কিছু লেখায় আছে এই বাংলার উত্তরভাগের মায়াময় প্রকৃতি আর সরল মানুষের মুখচ্ছবি। তাঁর একটি পত্র- উপন্যাসের এক চরিত্র বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ইফফাত আরা দেওয়ানের গান ভালবাসে। কলকাতা থেকে সে ঢাকার পত্রবন্ধুকে বারবার বলে ইফফাত আরার কথা।
২.৩০ আগস্ট শেষরাতে ঘুম ভাঙতেই ফেসবুক দেখছি, না এবার আর গুজব না। সত্যিই চলে গেলেন বুদ্ধদেব গুহ। অনেকের প্রিয় লালাদা। কিন্তু আমার কাছে তিনি ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ উপন্যাসের প্রিয় লেখক।
এখানে বইয়ের যে কপিটি দেখা যাচ্ছে তা প্রীতি স্টোর্স, কুমিল্লা থেকে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে কেনা। আমাদের পারিবারিক সংগ্রহ থেকেই প্রথমে স্কুলছাত্র, তারপর কলেজছাত্র, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্র থেকে এই এখন বছর সাড়ে ছত্রিশে দাঁড়িয়ে উপন্যাসটির মুগ্ধ পাঠক আমি। ফেসবুকে একাধিকবার লিখেছিও এটা নিয়ে। আমার অনেক কথাসাহিত্যিক বন্ধুর বিস্ময়, কী করে আমার এত প্রিয় হতে পারে এই বই!
আমি বলি অপার অরণ্যের জন্য ছুটির জন্য আর শীতঋতুর জন্য এটা আমার এত প্রিয়। বেঁচে থাকতে মানুষি হিংস্রতায় যখন ক্ষতবিক্ষত হই তখন আমি বিভূতিভূষণ আর বুদ্ধদেবে আশ্রয় নিই। বিশেষত ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ পড়ে পড়ে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রেমিক আমি। যেখানে ‘সামনে একটা বড় ঝাঁকড়া মহুয়াগাছ।।মাঝে মাঝে পিটিস এবং ঝাঁটি জঙ্গল। পশ্চিমের পাহাড়ের কাঁধ বরাবর সন্ধ্যাতারাটা উঠেছে। সমস্ত আকাশ সেই একটি তারার আলোয় উজ্জ্বল’।
আমি বলি অপার অরণ্যের জন্য ছুটির জন্য আর শীতঋতুর জন্য এটা আমার এত প্রিয়। বেঁচে থাকতে মানুষি হিংস্রতায় যখন ক্ষতবিক্ষত হই তখন আমি বিভূতিভূষণ আর বুদ্ধদেবে আশ্রয় নিই। বিশেষত ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ পড়ে পড়ে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রেমিক আমি। যেখানে ‘সামনে একটা বড় ঝাঁকড়া মহুয়াগাছ।।মাঝে মাঝে পিটিস এবং ঝাঁটি জঙ্গল। পশ্চিমের পাহাড়ের কাঁধ বরাবর সন্ধ্যাতারাটা উঠেছে। সমস্ত আকাশ সেই একটি তারার আলোয় উজ্জ্বল’।
জঙ্গুলে আবহে বসত গাড়া ছন্নছাড়া ছোট্ট রাজকুমার লাবু, ছোট হলেও স্বপ্নে সে উপন্যাসের কথক সফল মানুষ সুকুমারের চেয়ে অনেক বড়। কারণ লাবু তার ভালবাসার নারী যাযাবর নুড়ানীর জন্য সমাজ-সংসার ছেড়ে পাড়ি দিতে পারে চাঁদের পাহাড়, সাদা ঘোড়া আর অচেনা পাখির শিসে ভরা জঙ্গল কিন্তু সুকুমার তার ভালবাসার ‘ছুটি’-র জন্য ত্যাগ করতে পারেনা সংসার কিংবা সমাজের শেকল। ছুটি তার জীবনকে কানায় কানায় ভরে দিলেও সুকুমার তার দ্বিধার মুদ্রায় ছুটিকে হারাল। ছুটি সেই মেয়ে যে শরীরদেবতার শুচি-অশুচির চেয়ে মনোদেবতার শুদ্ধতাকে বেশি গুরুত্বে রাখে। ছুটির ঘরে তুষার রায়ের কবিতার বই দেখে চমকে উঠেছিল সুকুমার। আমারও সেই প্রথম ‘ব্যান্ডমাস্টার’-এর কবির নাম পড়া। ছুটি সুকুমারের সংসারী ও সন্ন্যাসীময় দ্বিচারিতাকে ব্যঙ্গ করে তুষার রায়ের কবিতায় আত্মার উলঙ্গ প্রকাশের কথা বলেছিল; যে প্রকাশ স্থগিত রাখতে রাখতেই সামাজিক গিলোটিনের বলি হয়ে যাই আমরা সবাই।
কী করে ভুলি প্যাটকে! সেই ‘রাতের বনের অন্ধকারে স্বয়ংসম্পূর্ণতার স্বপ্নবিলাসী একজন অভিশপ্ত একাকী ভঙ্গুর পুরুষমানুষ’, যিনি দীর্ঘ নারীহীন-সংসারচ্যুত জীবনের লোনলিলেস সেলিব্রেট করতে জানেন এভাবে রাতচেরা গান গাইতে গাইতে:
Show me the way to go home,
I am tired,
And i want to go to bed;
Show me the way to go home.
যেন সেই কবিতার কথা ‘ঘর নেই, আছে শুধু ঘরের দিকে যাওয়া’।
যেমন জীবন-ঘর থেকেও মৃত্যুঘরের দিকে যেতে চেয়েছেন জঙ্গলে একাকী বসতকারী বৃদ্ধ বয়েলস। কয়েকদিন আগে মরে থাকা মানুষটার চোখমুখ খুবলে নিচ্ছিল শকুন, পরে প্যাট-সুকুমার গিয়ে দেখেন বৃদ্ধের হাতে ধরা বাইবেলের গায়েও মাংসরক্তের টুকরো আর ছিটা। জীবনের এসব ভয়াবহ আরতি দেখেও শীতার্ত মানুষ বেঁচে থাকার বসন্তবাগান খোঁজ করে।
যেমন জীবন-ঘর থেকেও মৃত্যুঘরের দিকে যেতে চেয়েছেন জঙ্গলে একাকী বসতকারী বৃদ্ধ বয়েলস। কয়েকদিন আগে মরে থাকা মানুষটার চোখমুখ খুবলে নিচ্ছিল শকুন, পরে প্যাট-সুকুমার গিয়ে দেখেন বৃদ্ধের হাতে ধরা বাইবেলের গায়েও মাংসরক্তের টুকরো আর ছিটা। জীবনের এসব ভয়াবহ আরতি দেখেও শীতার্ত মানুষ বেঁচে থাকার বসন্তবাগান খোঁজ করে।
আর প্রতি শীতঋতুতে যেকোনো পৃষ্ঠা থেকে ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ পড়তে শুরু করে মাঝেমধ্যে আমি এই উৎসর্গবাক্য বা বিভাব-কবিতাটা পড়ে কুয়াশার আভায় মরি এবং বাঁচি:
” ভবিষ্যতের কোনো এক পড়ন্ত পৌষের শান্ত সুন্দর বিকেলে, মৃত ব্যাঙের মত শীতল আমার স্তব্ধ হৃদয়কে যারা তাদের নির্দয় ঠোঁটে উপড়ে নিয়ে আছড়ে ফেলবে তোমার অন্তরের অন্তঃপুরের বদ্ধ জানালায়, যারা তোমার উদ্দাম ইচ্ছার দূতী, তোমার হীন স্বার্থপরতার বাহক- সেই সব যূথবদ্ধ আশ্চর্য নিষ্ঠুর পিঙ্গল ঈগলদের উদ্দেশ্যে:
আমার স্পন্দিত হৃদয়ের অনুযোগহীন সমস্ত উষ্ণতার সঙ্গে; অতীতের ক্বচিৎ উষ্ণতার স্মারক আজকের এই পাণ্ডুর পাণ্ডুলিপি’।
Category: Book
Tags:
Share with others
Recent Posts
Recently published articles!
-
Mukto Library Desk
-
Super Admin
-
Nasir Khan
-
Super Admin