‘সুখলতার ঘর নেই’—অর্ণবদর্পণে মানবজীবন

মাওয়ার ইলিশ, পদ্মার ইলিশ, পায়রার ইলিশ, চাঁদপুরের ইলিশ—এক ইলিশের এদেশে স্থান এবং নদীসাপেক্ষে কত কত নাম! মাছবিক্রেতার মাথার সাজিতে চড়ে হাঁটতে হাঁটতে ইলিশের নামবদল হতে পারে এমন স্থান আর নদীর বিবেচনায়।

hero

মাওয়ার ইলিশ, পদ্মার ইলিশ, পায়রার ইলিশ, চাঁদপুরের ইলিশ—এক ইলিশের এদেশে স্থান এবং নদীসাপেক্ষে কত কত নাম! মাছবিক্রেতার মাথার সাজিতে চড়ে হাঁটতে হাঁটতে ইলিশের নামবদল হতে পারে এমন স্থান আর নদীর বিবেচনায়। বাণিজ্যোপকরণ হয়ে গেছে ইলিশের ব্যাপারটি আজকাল—তাও এক-দুদিনের কথা নয়। বহুদিন! প্রাপ্তিস্থান এবং চেকনাইবিচারে দামও হয় ঊর্ধ্বমুখী লেখে। আর আমরা আফসোস করি—এই সেদিনও ইলিশের এত দাম ছিল না! বাজারে আগুন!

আমরা সর্ষে ইলিশ, পাতুরি, কোর্মা, মুড়িঘণ্ট—এমন কতপদে ইলিশ খেতে বসে ভাবি না হয়তো কখনো, যার পেটিটা-মুড়োটা-ডিমটা গোগ্রাসে গিলছি, তার জালে ধরা দেবার পেছনে থাকতে পারে কত হাসি-কান্না-প্রাপ্তি-বঞ্চনার ইতিহাস! মাছ ত মাছই। তার আবার হাসি-কান্না কীসের?

‘সুখলতার ঘর নেই’ লিখতে গিয়ে কিন্তু হরিশংকর জলদাস ঠিকই ভেবেছেন এসব। চিন্তামণিদের টংজালে ধরা পড়বার মুখে ইলিশকন্যা সুখলতা সমুদ্রগহীনে ফেলে এসেছে তার হাসি-কান্না-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি-সমাজ-প্রেম। একটা স্বপ্নভাঙার যন্ত্রণার নাম—’সুখলতার ঘর নেই’।

বাঙালির জীবনের সাথে মাছ মিলেমিশে একাকার। জীবনসম্পর্কিত সবই ত সাহিত্যের উপাদান। তাই ঘুরেফিরে গদ্যে-পদ্যে মাছের আগমনে বাধা পড়েনি কোনোকালেই। ঘুমপাড়ানি গল্পে পান্তাবুড়িকে চোরের হাত থেকে রক্ষা করে শিং মাছ। আবার ঘুমের আগে দুপুরের খাবারে যে ইলিশের চামড়ার ভেতরে বিশেষ নরম মাংস, তার সাথে ইলিশ আর হরিণের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতার একটা গল্প মিশে আছে। জনপ্রিয় ঐতিহাসিক লোকচরিত্র গোপাল ভাঁড় ইলিশ কিনে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে পুরস্কার বাগিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলার বৈঠকী গল্পে মিশে আছে মৌরলা মাছের স্মৃতি। পল্লীকবির গল্প সংকলন ‘বাঙ্গালীর হাসির গল্প’-এ আছে মাছের আনাগোনা। আবার ঈশ্বর গুপ্ত তোপসে মাছ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। আবু ইসহাকের গল্পে ট্যাংরা মাছের তরকারির কথা এসেছে। মানিক এবং তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে খোদ হরিশংকর জলদাস পর্যন্ত অনেকেই উপন্যাসে-গল্পে মাছের কথা লিখেছেন প্রয়োজনমতো।

‘সুখলতার ঘর নেই’ উপন্যাসকে প্রতীকী উপন্যাস বলা যেতে পারে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশের মাছের গল্পের আড়ালে, একটু খেয়াল করে পড়লেই বোঝা যায়, হরিশংকর জলদাস মূলত মানুষের গল্প বলতে চেয়েছেন। এ দাবির স্বপক্ষে ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে এ লেখার পরবর্তী অংশগুলো পাঠে। হরিশংকর জলদাসের লেখায় প্রতীকী ধরণ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না তাঁর গল্প বলার ধরণে স্পষ্টবাদিতার কারণে। সাধারণত যে বয়সে মানুষের লেখকসত্তা বিকশিত হবার শুরু, তিনি তার অনেক পরে শুরু করেছেন লেখালেখি। একটা সাক্ষাৎকারে নিজেই এ বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, সাধারণত দেখা যায় প্রেমে পড়ে অথবা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মানুষের লেখকসত্তা জাগ্রত হলেও তাঁর ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি। বরং ভদ্রসমাজে প্রতিষ্ঠালাভের পর সমাজে অপমানের শিকার হয়ে রাগে, ক্ষোভে কলম ধরেছেন। বিষয় হিসেবে ব্যক্তিজীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে বেছে নিয়েছেন। প্রথম জীবনের সমুদ্রসংগ্রামের অভিজ্ঞতা তাঁর কলমে তাই ভাষা পেয়েছে বেশি। প্রকাশিত বেশিরভাগ উপন্যাসেই ছোটো করে হলেও জেলেচরিত্র রেখেছেন। মানবিক সাম্যের দাবিটিকে উচ্চকিত করতে চেয়েছেন বারবার। ফলে তথাকথিত ভদ্রসমাজের মুখোশের ওপরে ক্ষিপ্র থাবা ফেলতে হয়েছে তাঁকে। ভাষাগত রাখঢাক তাই বজায় রাখবার ধার ধারেননি, নেননি রূপকের আশ্রয়। এই বিচারে বলা যায় ‘সুখলতার ঘর নেই’ উপন্যাসটি মোটাদাগে একটি নিরীক্ষণধর্মী উপন্যাস হিসেবেই লিখেছেন বিষয়বৈচিত্র্যের সুলুকসন্ধানে।

মাছকে চরিত্র হিসেবে লিখেছেন কেউ, এমন তথ্য এই সত্যে দাঁড়িয়ে আছে যে, হরিশংকর জলদাস লিখেছেন ‘সুখলতার ঘর নেই’। আমাদের সুখলতা ইলিশকন্যা। ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্সের ব্যানারে ‘Finding Nemo’ চলচ্চিত্রটি দেখা হয়েছে আমার। মাছেদের জীবন নিয়ে নির্মিত ছবিটির সঙ্গে ভাবগত যে মিলটি ‘সুখলতার ঘর নেই’ উপন্যাসে পেয়েছি সেটি হচ্ছে—মানুষ মাছের শত্রু। সুখলতাদের শত্রু হিসেবে জলপুত্র চিন্তামণি গংদের সূক্ষ্মভাবে দেখিয়েছেন হরিশংকর জলদাস। আমরা তাঁর লেখায় জেলেচরিত্র অহরহ পাই। এ উপন্যাসের পটভূমি সমুদ্রতল হওয়ায় জেলেচরিত্র বা মানবচরিত্র অতটা গুরুত্বপূর্ণ না হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবু চিন্তামণির ছেলে পুলককে গুরুত্ব দিতে হবে আলোচনায়।

সাদাচোখে ইলিশকন্যা সুখলতা আর পাঙাশপুত্র রতিকান্তের প্রণয়ের আখ্যান ‘সুখলতার ঘর নেই’। জেলেজীবনের ছোট্ট সাবপ্লটে আমরা দেখি পুলক একজন প্রেমিক। যখন জোছনাবিলাসে গিয়ে রতিকান্ত চিন্তামণির জালে আটকে যায়, তখন তার আশেপাশে জালের বাইরে ঘোরাফেরা করে সুখলতা। যেন কিছু বলতে চায় সে। পুলক তার প্রেমিকহৃদয় দিয়ে এই দুটো ভিন্ন জাতের মাছের প্রেমের ভাষা বুঝতে পারায় রতিকান্তকে মুক্ত করে দেয়।

এই জায়গাটিতে আমরা দেখি জাতভেদ শিকেয় তুলে প্রেমের বিয়েতে আবদ্ধ এক প্রেমিকজুটির ছায়া সুখলতা-রতিকান্তের মধ্যে পাওয়া যায়। হিন্দুমতে এতদাঞ্চলে গন্ধর্ব বিবাহের প্রথা চালু আছে যা জাতিভেদকে অস্বীকার করে অনুষ্ঠিত হয়। উপন্যাসে পুলকের প্রেমেও অনুরূপ জটিলতা আছে বটে।

কম গুরুত্বপূর্ণ জনবসতির আরেকটি প্লটে বলা হচ্ছে জলদস্যুদের প্রসঙ্গে। এরা যে ধনসম্পত্তি লুটপাট করতো সে ইতিহাসের ইঙ্গিত রয়েছে এ জায়গাটিতে। মনে পড়ে হুমায়ুন কবির রচিত ‘নদী ও নারী’ উপন্যাসে মালেক অপহরণের প্রসঙ্গটি। আসলে এ ক্ষুদ্র বিবরণে ‘সুখলতার ঘর নেই’ উপন্যাসের সংঘটনকাল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। সমসাময়িক কালের কথা যে উপন্যাসে আসেনি, সে ব্যাপারটি স্পষ্ট এতে‌। তবে এ কালেও এ উপন্যাস তুলনামূলকভাবে বেশি প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে, সুখলতা রতিকান্তের সন্দেহের বলি হয়ে আত্মবলির চিন্তা করে শেষমেশ। এখনকার বহু প্রেম এবং দাম্পত্যের সম্পর্কে কাটাছেঁড়ার মূলে সন্দেহব্যাধি স্বমহিমায় বর্তমান। বিশেষ করে সঙ্গিনীর সতীত্বের প্রশ্নে বেশি সন্দেহপ্রবণ হয় এ সময়কার তরুণরা। ভেবে দেখি একটু, এ উপন্যাসের কালবিচারে সে সময়কার নরনারীর মধ্যে কিন্তু সন্দেহপ্রবণতা আসবার মতো মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তেমন ছিল না। আমরা হরিশংকর জলদাসের উপন্যাসরচনার সামগ্রিক হিসেবে বসলে দেখি তিনি অতীত আর বর্তমানকে সমান্তরালে লিখে এক বিন্দুতে মেলাবার চেষ্টা করেছেন ঘটনা পরম্পরা। তাঁর এককপাঠ হিসেবে ‘সেই আমি নই আমি’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, এবং ‘কসবি’ ও ‘মোহনা’র একত্রপাঠ আমাদেরকে এভাবে ভাবায়। প্রসঙ্গত দাম্পত্যে সন্দেহবাতিকতা তথা Othello Syndrome-এর মতো জটিল মনস্তত্ত্ব আমরা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসে দেখি। সেখানে শ্রাবণী তার স্বামী তনয়কে সন্দেহ করে করে মানসিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অবস্থান নেয়। হরিশংকর জলদাস লিখেছেন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসে—

“সেই থেকে দাম্পত্যজীবনকে নরক করে তোলে শ্রাবণী। কথায় কথায় দোলনকে জড়িয়ে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলতে দ্বিধা করে না। অফিস থেকে ফেরার বিলম্বকে দোলনের সঙ্গে যুক্ত করে। একা কোথাও বেরোতে চাইলে বলে—কারো সঙ্গে দেখা করার ব্যাপার আছে নাকি? প্যান্টের সামনের অংশ গভীর নিরীক্ষণে যাচাই করে এতে কোনো সন্দেহজনক পদার্থ লেগে আছে কিনা?

‘সুখলতার ঘর নেই’ উপন্যাসে রতিকান্তের সন্দেহ প্রবল তা ত আগেই বলেছি। এই জায়গাটির গুরুত্ব বোঝাতে হরিশংকর জলদাস লিখেছেন—

“… প্রাণিজগতের সবচেয়ে বড় শত্রুর নাম সন্দেহ। এই সন্দেহ একবার যার মধ্যে জায়গা করে নেয়, তার শুভবোধ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। …”

আমরা দেখি শুভবোধের মাথা খেয়ে রতিকান্ত সুখলতাকে বলছে—

‘তুমি দ্বিচারিণী। তুমি অসতী। তুমি জগাইয়ের উচ্ছিষ্ট। তোমার যেদিকে ইচ্ছে চলে যেতে পারো। যাকে ইচ্ছে তাকে নিয়ে ঘর বাঁধতে পারো।’

এরপর ঘটনার আকস্মিকতায় সুখলতা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়। ওদিকে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসেও ঘটনার ঘনীভবনে আমরা তনয়কে আত্মহত্যা করতে দেখি। প্রসঙ্গত এ উপন্যাসের শুরু থেকেই তনয় আত্মহত্যাপ্রবণ।

আবার, জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে হালিমা আবুলের সন্দেহপ্রবণতার বলি হয়। আবুলের মার খেয়েই তার মৃত্যু হয়। অবশ্য আগেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল সে পেয়ারা গাছে ফাঁস নিয়ে।

উপন্যাসের মূল পটভূমিতে আমরা হীরামোহন ডাক্তারকে পাই। বলাবাহুল্য, হীরামোহন মানুষ নয়, মাছ। মাছেদের সমাজে ডাক্তার হিসেবে খ্যাতিমান। ভূয়োদর্শী এই ডাক্তার সমগ্র উপন্যাসেই প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ। জগাইয়ের পূর্বপুরুষেরও অব্যর্থ চিকিৎসক হীরামোহন। রতিকান্ত-সুখলতার বিয়ের ঘটক হীরামোহন। সে বিচারে শ্রেণিভাবনাপ্রবণ মৎস্যসমাজে দুই ভিন্ন জাতের মাছের এই আপাত অসম প্রেমের প্রতিষ্ঠা ডাক্তারের হাতেই হয়েছে। তার ডাক্তারিতে সেরে উঠেছিলেন মাছনন্দিত সরদার বিনোদ। পরে আহত রতিকান্তকেও সারিয়ে তোলে হীরামোহন।

ডাক্তারচরিত্র ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসেও এসেছে। তবে অমিতাভবাবুকে সেভাবে বিকশিত হতে দেখিনি। অবশ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জননী’ উপন্যাসে হারান ডাক্তারের কথা মনে পড়েছে এ প্রসঙ্গে। মানিক লিখেছেন—

“… জীবন-মরণের ভার যে ডাক্তার পান চিবাইতে চিবাইতে লইতে পারে সে-ই তো ডাক্তার।”

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সপ্তপদী’ উপন্যাসের কৃষ্ণস্বামীও জনপ্রিয় ডাক্তার চরিত্র বটে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বিপিনের সংসার’ উপন্যাসে এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দত্তা’ উপন্যাসে ডাক্তার চরিত্র লিখেছেন।

তবে হীরামোহনের মাছপরিচয় এসকল ডাক্তার থেকে তাকে অনন্য করে রেখেছে—বলতেই হয়।

হীরামোহনের বড়ো কৃতিত্বের পরিচয় সমুদ্রতলের অর্ণবব্যাধি নামের মহামারির প্রাদুর্ভাব দূর করা। এতে যদিও তার ডাক্তারির শিক্ষকের ভূমিকাও আলোচ্য। মনোকামনা বৃক্ষের অবতারণা উপন্যাসে এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক মৎস্যসমাজের প্রথাবিচারেও।

আমরা দেখি, সমুদ্রতলেও ক্ষমতাদখলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তা এতটাই অসুস্থ যে পিতার মৃত্যুর আয়োজনও তার কাছে ছার। পঞ্চু সরদারের খলামির এখানেই শেষ নয়, বখাটে সন্তান জগাইয়ের নারীলোলুপতা তাকেও ছুঁয়ে যায়। অন্যের স্ত্রীকে নিজের সন্তানের জন্য তুলে আনার নীলনকশায় পঞ্চুর জুড়ি মেলা ভার।

সুখলতার পূর্বসূরির ইতিহাসে আমরা দেখি খাবারের অভাব পড়ায় জলধি গ্রামে এসে বসবাস শুরু করে তারা। আদিবাস পত্তনিতে হাঙরদের অতর্কিত আক্রমণকে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। মানবসমাজের ভূমিদখলের সংস্কৃতির সাথেও তুলনা করা যেতে পারে সুখলতার পূর্ববর্তী ইতিহাসকে। প্রসঙ্গত ভূমিদখলকে উপজীব্য এবং উপাদান করে হরিশংকর জলদাস যথাক্রমে ‘কুন্তীর বস্ত্রহরণ’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসদুটো লিখেছেন।

রতিকান্ত-সুখলতা-জগাইয়ের জটিলতা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে গড়ায়। এমন সম্মুখযুদ্ধের বিবরণ হরিশংকর জলদাসের ‘মোহনা’ এবং ‘সেই আমি নই আমি’ উপন্যাসে এসেছে।

মাছনন্দিত সরদারপদ পেয়েছিলেন অবশেষে সুখলতার বাবা সোমনাথ। ক্ষমতায় নির্লোভ এই চরিত্রটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্বের ছায়ায় নির্মিত কিনা, ভাবায়। তার একটি সংলাপ ছিল একপর্যায়ে—

‘আমি সরদারি চাই না। আমি সাধারণ মাছেদের মঙ্গল চাই। তারা যাতে সুখে-আহারে জীবন কাটাতে পারে—এই আমার কামনা।’

সুখলতার দুঃস্বপ্নের ব্যাপারটি ভুলবার নয়। পতিবিয়োগের দুঃস্বপ্নে তার চোখে উন্মোচিত হয়েছে মানবসমাজের লোভী পুরুষের নষ্টচোখের নমুনা। নারী বিধবা হলে চতুর্দিকের পুরুষগুলোর লোলুপদৃষ্টি তাকে কুরে খেতে চায় বারবার। নারীর প্রতি সহিংসতার একটা রূপ এটা। এরকম একটা বিরুদ্ধপরিবেশেও সুখলতার ব্যক্তিত্বে এক স্বাধীনচেতা মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাকে স্বাধীনতা দেয়? জেনেশুনেও প্রথা ভেঙে বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরালয়ে যাবার পথে বন্দি হয় সে। শেষ পর্যন্ত স্বামী রতিকান্তের সন্দেহের জাল থেকে মুক্ত হতে চিন্তামণিদের জালে আত্মহত্যায় আশ্রয় খোঁজে।

মানবসমাজে নারীর প্রান্তজনসত্তা প্রকটিত হয়েছে সুখলতার করুণ পরিণতির আভাসে। নারীকে সমাজে নানাবিধ বৈষম্যের শিকার হতে হয়। শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রই সুখলতার আড়ালে হরিশংকর জলদাস তুলে ধরেছেন। সাগরতলের একেবারেই অচেনা জগতে স্থলভাগের মানবজীবনের যে স্পষ্ট ছায়াপাত উপন্যাসে এসেছে, সেখানেই প্রতীকী উপন্যাসবিচারে ‘সুখলতার ঘর নেই’ সার্থক।

Category: Book

Tags:

Share with others